এখন_কোথায়-যাব!!
গল্পের রুপকার
জান্নাতুল ফেরদৌস আলেয়া
জেলা ও দায়রা জজ,
লেখক
ফরজুন আক্তার মনি
সম্পাদক ও প্রকাশক
দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ নিউজ টিভি.কম।
আমি সেতু।
আমার মা আজ রাতে মারা গেছেন। প্রথমে কনফার্ম ছিলাম না। অনেকক্ষণ মাকে
ঠেলাঠেলি করেছি, নাকের কাছে, মুখের কাছে হাত দিয়ে নিঃশ্বাস বুঝার চেষ্টা করেছি। বুঝতে পারিনি। আমরা তিন বোন। আমি সবার বড়।আমি ময়মনসিংহের বিদ্যাময়ী স্কুলে দশম শ্রেণীতে, মিতু অষ্টম শ্রেণীতে এবং ঋতু কাঁচিঝুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। এর আগে কাছ থেকে কোন মৃত্যু দেখিনি আমরা। মাত্র তিনদিনের জ্বরে মা এভাবে হঠাৎ করে চলে যাবেন, বুঝতেই পারিনি। রাত সাড়ে দশটা / এগারোটার দিকে হঠাৎ মার শ্বাসকষ্ট শুরু হলে ময়মনসিংহের মানবিক ডাক্তার হিসেবে খ্যাত, ডাক্তার প্রদীপ চন্দ্র কর বাবুকে ফোন দিয়েছিলাম। একজন ভদ্র মহিলা ফোনটা ধরেই বললেন, ডাক্তার বাবু ঘুমাচ্ছেন, তিনি অসুস্থ, তাঁকে দেয়া যাবে না, আমি যেনো বিরক্ত না করি। মাকে জোরে জোরে নাড়াচ্ছি, ডাকছি, চিৎকার করে কাঁদছি, মার কোন সাড়া নেই। তবে মার চোখটা সামান্য খোলা। মনে হয় আমাদের দেখছেন।
রাত তিনটা সাড়ে তিনটা থেকে মার শরীর ঠান্ডা হতে শুরু করে। মিতু রসুন দিয়ে সরিষার তেল গরম করে এনে মার হাতে, পায়ে, গলায়, বুকে ডলছে। কোন কাজ হচ্ছে না। বাইরে বৃষ্টি বাতাস। মার চুয়াল দুটোও বরফের মতো ঠান্ডা আর শক্ত হয়ে গেছে। পা দুটোও আগের মতো বাঁকাতে পারছি না। মার নিথর দেহ আমাদের কান্না থামাচ্ছে না। যতক্ষণ মার জ্ঞান ছিলো,
আমাদের হাসপাতালে নিতে নিষেধ করেছেন। মা জানতেন,ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কোন সিট খালিনেই। মেঝেতে,বারান্দায়ও লোক ধরে না। যাদের প্রভাব আছে তারাও অনেক যুদ্ধ করে সিটের ব্যবস্থা করতে পাচ্ছেন না। আর আমরা তো অতি নগন্য মানুষ। মার একশো তিন জ্বর, প্রচন্ড গলাব্যথা, গা ব্যথা, সবই ছিলো। তবে প্রথমদিকে কাশিটা ছিলো না। মা নাপা এক্সটেন্ডেড খেয়েছেন। মাঝে মাঝে জ্বর একটু কমেছে বলেও মনে হয়েছে। মশলা চা, গরম পানি খাওয়া, গারগেল করা সবই করেছেন। কিন্তু পরবর্তীতে কাশিটা বেড়ে যায়। মাথায় প্রচন্ড যন্ত্রণা অনুভব করেন। পরদিন ডায়রিয়াও দেখা দেয়। স্যালাইন খাওয়াই, জাও ভাত দিই, মার বমি আসে। কিছুই খেতে পারেননি। মা দ্রুত দুর্বল হতে থাকেন। মাকে হাসপাতালে নেওয়ার কথা বলতেই মা আপত্তি করেন। হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করাবে কে, আমরা তিনবোন একা বাসায় কিভাবে থাকবো, মার সাথে হাসপাতালে থাকবে কে, রাতবিরাতে ঔষধপত্র আনবে কে,এসব কারণে মা বাসায়ই চিকিৎসা নিবেন। টাউনহলের মোড়ে বসেন ডাক্তার গণি। তিনি বাবাকে চিনতেন। তাঁর সাথে পরামর্শ করে
এন্টিবায়োটিকও নিয়ে আসলাম। মার করোনার সব উপসর্গ দেখা গেছে, সে কথা জানলে কেউ আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে না।
আমার বাবা কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে
২০১৮ সনের ডিসেম্বরে ভারতের একটি হাসপাতালে মারা যান। মা তাঁর লাশটাও দেশে আনতে পারেননি। বাবার চিকিৎসা চালাতে আমরা প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়ি। আমার বাবা ডিসি অফিসের কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু সততার কারণে তাঁর কোন বাড়তি আয় ছিলো না। মা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক।
এ দিয়েই আমাদের তিনবোনের পড়াশোনা ও সংসার চলতো। মাঝে মাঝে দাদা বাড়ি থেকে মাছ, আতব চাল আসতো। নানু যতোদিন সচল ছিলেন ততদিন মামাবাড়ি থেকেও পোলাও এর চাল,চালের গুঁড়া, শুটকি, নানারকম পিঠা, সরিষার তেল, কলা, শাকসবজি, ফলমূল আসতো। আমার মামাবাড়ি নেত্রকোণার খালিয়াজুড়ি, আর দাদাবাড়ি কিশোরগঞ্জের নিকলীতে। খালিয়াজুড়ি ভূমি অফিসে যখন বাবার পোস্টিং ছিলো, তখনই মার সাথে বিয়ে হয়। আমাদের দু’বোনের জন্মও খালিয়াজুড়িতেই। বাবার তৎকালীন ভূমি কর্মকর্তা ময়মনসিংহে এডিসি হয়ে আসার পর বাবার সততা ও কর্মনিষ্ঠার জন্যে বাবাকে বদলী করে ময়মনসিংহে আনেন। তাঁর প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপেই মা-ও বদলী হয়ে আসেন ময়মনসিংহের কাঁচিঝুলি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।
ভাটির দেশের মানুষ হঠাৎ শহরে এসে সে কী আনন্দ আমাদের! এতো উঁচু উঁচু দালান, বড় বড় পাকা রাস্তা, দু’তিন তলা মার্কেট, সার্কিট হাউজের সামনের বিশাল সবুজ মাঠ, লম্বা পার্ক, এতো আলো, যা দেখি তাতেই অবাক হই। আর এখন! ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে না গেলে আর পানির দেখা নেই। তবে ময়মনসিংহে আসার পর আমি রোজ সকালে বাবার হাত ধরে নদীর পাড়ে হাঁটতাম। আমার ছোটবোন মিতু তখনো ঘুমাতো। হাঁটা শেষে প্রতিদিনই বাবা কিছু না কিছু টাটকা মাছ, শাকসবজি,
গরুর দুধ নিয়েই বাসায় ফিরতেন। তখন কাঁচিঝুলিতে জেলখানার পেছনে আমাদের বাসা ছিলো। আমরা হেঁটে বাসায় ফিরে দেখতাম মার নাস্তা প্রায় রেডি। ছোটা খালা এসে ঘরবাড়ি পরিষ্কার করে, বাসন ধুয়ে ,
শাকসবজি,মাছ গুছিয়ে চলে যেতেন। আমরা গোসল সেরে নাস্তা খেয়ে চারজনই একসঙ্গে বেরিয়ে পড়তাম। মিতু মার সাথে স্কুলে, আর বাবা আমাকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে অফিসে যেতেন। ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যেতো। আমাদের স্কুল বন্ধ থাকলেও আমার কাজ পাগল বাবা কখনো দুপুরে খেতে বাসায় আসতেন না। বাবার বাসায় ফিরতে প্রতিদিনই রাত হয়ে যেতো। তবুও আমাদের সংসারে ছিলো উপচে পড়া আনন্দ। মা-বাবার মাঝে এতো বুঝাপড়া ছিলো যে, দু’জনকে এক মানুষ মনে হতো। এর মাঝে মার কোল জুড়ে আসলো ঋতু। আমাদের আনন্দ আর ধরে না। মা-বাবা ছেলে সন্তানের জন্যে প্রার্থনা করে ছিলেন কি না জানি না। এ বিষয়ে কখনো তাঁদের আক্ষেপ করতে দেখিনি। বাবা বলতেন, “ছেলেমেয়ে বড় কথা নয়, বড় কথা হচ্ছে মানুষ হওয়া। মানুষ না হলে ছেলেই কী, আর মেয়েই কী!”
আমার জন্মের পর তাঁদের মাঝখানের সেতুবন্ধন হিসেবে আমার নাম রাখেন সেতু। যদিও বাবা কখনোই আমার নাম ধরে ডাকতেন না। সবসময়ই মা বলতেন। শুনেছি, বাবা যখন ক্লাস সেভেনে পড়েন, তখন নাকি সন্তান প্রসব করতে গিয়ে আমার দাদী মারা যান। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে বাবা ছিলেন সবার বড়। দাদার সাথে সাথে বাবাও তাদের লালন পালন করেছেন। আষাঢ়ের এক লন্ঞ্চ ডুবিতে মারা যান দাদা। সেজন্যে ভালো ছাত্র হওয়া সত্বেও বাবা পড়াশোনা বেশি করতে পারেননি। কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেই চাকরিতে যোগদান করেন। তখন চাকরি পেতে নাকি টাকা দিতে হতো না, কোন সুপারিশও লাগতো না। বাবা চাকরি করে ভাইবোনদের পড়াশোনা শিখিয়ে বিয়ে দিয়েছেন। সেজন্যে বাবার বিয়ে করতে নাকি দেরি হয়ে গেছে। আমার চাচা- ফুফুরা কিশোরগঞ্জের নিকলীতেই থাকেন।
বাবার চিকিৎসা খরচ চালাতে মা যখন হিমসিম খাচ্ছিলেন, তখন বাবা মাকে নিকলীতে পাঠিয়ে ছিলেন, তাঁর নিজের টাকায় কেনা জমি বিক্রি করে চিকিৎসার খরচ যোগাড় করার জন্য। মা গিয়ে জানতে পারেন, বাবা চাকরি করে জমি কেনার জন্যে চাচাদের যে টাকা পাঠিয়েছিলেন,
সে টাকা দিয়ে চাচারা নিজেদের নামে জমি কিনেছেন, বাবার নামে কোন জমিই কিনেননি! কথাটা জানার পর বাবা অঝর ধারায় কেঁদেছিলেন। এর পর চাচারা কেউ আর বাবাকে দেখতেও আসেননি। এদিকে বাবার শরীর এতোই খারাপ হতে থাকে যে, ডাক্তাররা তাঁকে দ্রুত ভারতে নেয়ার পরামর্শ দেন। আমার এসএসসি পাস মায়ের মাথায় যেনো আকাশ ভেঙে পড়ে। কিন্তু তিনি হাল ছাড়ার পাত্রী নন।
জরুরী ভিত্তিতে পাসপোর্ট করে, বাবার প্রভিডেন্ট ফান্ড থেকে লোন নিয়ে ও বাবার সহকর্মীদের সহযোগিতায় চলে গেলেন ভারতে, সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা পথে, একা একা। আমাদের পাঠিয়ে দিলেন মামাবাড়িতে, নানুর কাছে। তখনও নানু মোটামুটি হাঁটাচলা করতে পারতেন। আমাদের বাসায় তালা,পড়াশোনা বন্ধ।
তিনমাস পর মা একা দেশে ফিরলেন, বাবাকে ওখানে রেখে। টাকা ও লোকবলের অভাবে মা বাবার লাশটাও দেশে আনতে পারেননি। বাবার সাথে আমাদের আর দেখা হলো না। দেশে ফিরলেন এক অচেনা মা। বোবার মতো চেয়ে থাকেন। কখনো হাসেন না, আমাদের সাথেও তেমন কথা বলেন না। সারাক্ষণ কী যেনো চিন্তা করেন। এদিকে বাবার চলে যাবার খবর শোনে
নানু একাধিকবার স্ট্রোক করেছেন। পরবর্তীতে প্যারালাইসড হয়ে যান। মাকে স্কুল থেকে নোটিশও দিয়েছে কাজে যোগদানের জন্যে। এতো টানাপোড়েনে মা দিশেহারা। বাবার চিকিৎসা চালাতে গিয়ে ঋণও হয়েছে অনেক। মা খুব আশা করে ছুটে গিয়েছিলেন নিকলীতে। বাবার পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ বিক্রি করে ঋণ মিটাবেন বলে। চাচারা সাফ জানিয়ে দিলেন,
যখন প্রথম ক্যান্সার ধরা পড়ে তখনই নাকি বাবা তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তির অংশ চাচাদের কাছে বিক্রি করে টাকা নিয়েছেন। তাদের কাছে নাকি দলীলও আছে! যদ্দুর মনে পড়ে বাবা অসুস্থ হওয়ার পর বড় চাচা মাত্র একবারই এসেছিলেন। কিন্তু জমি বিক্রি করলে মা জানবেন না! জগতে কতো বিচিত্র কিছুই ঘটে। সহজ মানুষেরা তার কতোটাই বা জানে!
মার মানসিক অবস্থা বুঝতে পেরে বাবার সহকর্মীরা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে বাবার পেনসনের যাবতীয় ব্যবস্থা করে দিলেন। মা
কাগজে স্বাক্ষর করলেন মাত্র। মুদ্রার এপিট ওপিঠ কতো ভিন্ন!
পেনসনের টাকা পেয়ে মা ঋণ পরিশোধ করে অবশিষ্ট টাকা দিয়ে শহরতলী কাঠগোলায় দশ শতক জায়গা কিনে চারদিকে বাউন্ডারি দিয়ে তিনরুমের একটি হাফ বিল্ডিং করলেন, সামনের বারান্দায় গ্রীল লাগালেন, পেছনের বারান্দায় রাখলেন কিচেন, ডাইনিং ও বাথরুম।
পানির মটর বসালেন। যাতে রাতের বেলা আমাদের ঘরের বাইরে না গেলেও চলে। আবার উঠানের এককোণায় কিচেন ঘেঁষে একটি টিউবওয়েলও বসালেন। কারেন্ট না থাকলে আমরা সেখান থেকে পানি তুলি। এসব কাজে মাকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন বাবার সহকর্মী ও কলেজের সহপাঠী বন্ধু আজমল চাচা। আমার গৃহী মা বাসার সামান্য খালি জায়গায় বারমাসি বেগুন, পেঁপে,কাঁচামরিচ,কাঁচকলা,আদা,ধনেপাতা,পুদিনাপাতা,কালিকচু, তুলসীগাছ লাগিয়ে রেখেছেন। আর মৌসুমী
শাকসবজিতে মার দারুণ ঝোঁক। লাউ, সীম,ঢেঁড়স, লালশাক, চালকুমড়া, পাটশাক, করলা, পুঁইশাক,কখনো কিনেছেন বলে মনে হয় না। বাসার পেছনে লাগানো তিনটি আম্রফালি গাছে এবার আমও ধরেছিল। আর আমাদের তিনবোনের যত্নে করা ফুলের চাষ দেখে মা ভীষণ খুশি হতেন। আমাদের গেইটে জারুল গাছে দুলে আছে মাধবীলতা। শিউলী গাছটা উঠানের এককোণায়। তিনবছরেই অনেক বড় হয়ে গেছে। গতবছর থেকে ফুলও আসছে। বেলী গাছটা একদম সামনের বারান্দার সাথে
দরজার একপাশে। সাদা সাদা ফুলে ভরে আছে গাছটা। রাতের অন্ধকারে ফুলগুলোকে মনে হয় যেনো থোকা থোকা আলো। গোটা বারান্দা লাগোয়া ঘাসফুল। সকাল নয়টায় মনে হয় সেখানে যেনো প্রজাপতির মেলা বসেছে। টিউবওয়েলের একপাশে ফুটেছে দোলনচাঁপা। বেলী,দোলনচাঁপা মার খুব প্রিয়। ক’দিনের একটানা বৃষ্টিতে হেলে পড়েছে দোলনচাঁপার
ঝাড়টা। মা অসুস্থ থাকায় আমরা কেউ সেটা খেয়ালই করিনি! এখন এসবে মার আর কিচ্ছু যায় আসে না। মার নিথর দেহের উপর আমাদের আহাজারি শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে। কোথাও কেউ নেই যে, আমাদের একটু শান্ত্বনা দেবে। আজমল চাচা গতবছর আগস্টে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন। চাচী গৃহিণী বলে বাচ্চাদের নিয়ে কিশোরগঞ্জে তাঁর বাবার বাড়িতে চলে গেছেন। এখন এখানে আমাদের বলতে কেবল আমরাই। আর কেউ নেই। মার স্কুলের আগের প্রধান শিক্ষক নিয়মিত আমাদের খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি বদলী হয়ে যাবার পর নতুন যে প্রধান শিক্ষক এসেছেন, তিনি মনে হয় আমাদের পরিবার সম্পর্কে কিছুই জানেন না। আমার স্বল্পভাষী মা আগ বাড়িয়ে নিশ্চয় তাঁর দুঃখের কথা নতুন কাউকে বলতে যাননি। তাছাড়া উনি ২০২০ সনের জানুয়ারীতে যোগদান করেছেন, আর মার্চের পনেরো তারিখ থেকে স্কুল বন্ধ হয়ে এখনো বন্ধই চলছে। এর মাঝে জরুরী কাজে মা কয়েকবার মাত্র স্কুলে গেছেন।তাই উনার জানারও কথা না। আগে মা স্কুল ছুটির পর, ছুটির দিনে টিউশনি করতেন। এতে একটু বাড়তি আয় হতো। মাকে সহযোগিতা করার জন্যে আমিও মার স্কুলের পাশে আমাদের আগের প্রতিবেশীর দুটো বাচ্চাকে পড়াতাম।এতে আমার আর মিতুর কোচিং এর ফি টা হয়ে যেতো। ঋতুকে আমরাই পড়াতাম। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিলো আমাদের মার ভাঙা সংসার। এখন করোনার কারণে সবই বন্ধ।
বাবা সুস্থ থাকতে চাচারা বাড়ি থেকে আতব চাল, মাছ, হলুদ, মরিচ,আম, কাঁঠাল ও বাদাম সহ নানা কিছু পাঠাতেন। বাবা মারা যাবার পর আর একবারও পাঠাননি। আমাদের তেমন খোঁজও নেননি। মাঝে মাঝে মা ফোন করলেও কেমন দায়সারা গোছের জবাব দেন। মাও আর কথা বাড়ান না। আমার নিরীহ মার পক্ষে নামমাত্র পরিচিত শ্বশুর বাড়িতে গিয়ে অকৃতজ্ঞ দেবরদের সাথে লড়াই করে বাবার সম্পত্তি উদ্ধার করা সম্ভব নয়, তা বুঝতে পেরেই এভাবে চুপ করে থাকতেন। আমার নানু যতোদিন সচল ছিলেন ততোদিন নানাবাড়ি থেকেও কতো কিছু আসতো! নানু থরে থরে সব জমিয়ে মার জন্যে পাঠাতেন। সেখানে শুকনা পাটশাক, শিদল,আমের ফলসিও থাকতো। আমরা নানুবাড়ির পিঠার জন্যে অপেক্ষা করে থাকতাম। নানু মুইঠা পিঠার মধ্যে ভাতভর্তি ঢাকনাসহ বানিয়ে পাঠাতেন। আমরা তিনবোন সেগুলো নিয়ে কাড়াকাড়ি করতাম। এখন সে সব কেবলই গল্প। এখন আমাদের দাদাবাড়ি নেই, মামাবাড়ি নেই। আমার জনম যোদ্ধা মা কারো সাহায্য ছাড়াই একা একা নীরব যুদ্ধ করে চলেছেন। নানু প্যারালাইসড হবার পর থেকে মামা-মামীরা নানুর উপরই বিরক্ত। যদিও মা প্রতিমাসে নানুর খরচের জন্যে কিছু টাকা বিকাশে পাঠিয়ে দেন। এমতাবস্থায় আমরা নানাবাড়িতে গিয়ে মামীদের কাজকাম করে দিলে তারা হয়তো ভাগাভাগি করে আমাদের রাখবেন। শুনেছি গার্মেন্টেসের কারণে গ্রামেও নাকি এখন আর কাজের মানুষ পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা যদি সেখানে গিয়ে পড়াশোনা করতে চাই তখনই ঘটবে বিপত্তি। মাঝখান থেকে নানুর কষ্ট আরও বেড়ে যাবে।
একই ঘটনা ঘটবে দাদাবাড়িতেও। তবুও ভোর হলে মার চলে যাবার খবরটা মামা-চাচাদের জানাতে হবে। আজ পাঁচ-ছয় দিন একটানা বৃষ্টি। শ্রাবণের ঢলে আমার মামাবাড়ি, দাদাবাড়ির এলাকা নিশ্চয় পানিতে তলিয়ে গেছে। সেখানে কোন মতে বাড়ির সামান্য জায়গা উঁচু হলেও বাকী সব বর্ষাকালে অথৈ পানিতে তলিয়ে যায়। প্রতিবছরই বর্ষাকালে
এমন হয়। বাড়ির চারদিকে থৈ থৈ পানি। আর তার মাঝখানে গ্রামের ছোট ছোট ঘরগুলো যেনো নাক উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। আগে প্রতি বছরই এক- দু’বার আমরা দাদাবাড়িতে যেতাম। কখনো কখনো ঈদেও যেতাম। বাবা একাই একটা আস্ত গরু কোরবানি দিতেন। মাংস নিয়ে বাবার সাথে ফুফুদের বাড়িতে যেতাম। তখন কী কদর ছিলো আমাদের! বর্ষাকালে নৌকায় উঠলেই বাবা আমাদের দু’বোনকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে রাখতেন। আমরা সাঁতার জানতাম না বলে বাবা কিছুতেই হাত ছাড়তেন না। মা-ও ভাটির দেশের মেয়ে। তিনিও সাঁতারে অভ্যস্ত ছিলেন। খাল,বিল পেরিয়েই নাকি তাঁদের স্কুলে যেতে হতো।
মনে হয় ভোর হয়ে আসছে।
মসজিদের মুয়াজ্জিন মাইকে ফু দিচ্ছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আযান হবে। মিতু, ঋতু এখনো কাঁদছে, কাঁদতে কাঁদতে তাদের গলার স্বর ক্ষীণ হয়ে গেছে। আমি স্তব্ধ হয়ে অচেনা এক ভোরের অপেক্ষা করছি। মার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার করণীয় নিয়ে ভাবছি। ওরা দু’জনেই মার গালের সাথে গাল লাগিয়ে, বুকের মাঝে মাথা রেখে কাঁদছে। আমি থামানোর কোন চেষ্টাও করছি না। কাঁদুক। প্রাণ ভরে কাঁদুক। আমার চোখের জলে বন্যা বয়ে যাচ্ছে,
কিন্তু কান্নার কোন আওয়াজ বেরুচ্ছে না। কাঠগোলা জামে মসজিদে আযান হচ্ছে। আস্তে আস্তে সরে যাচ্ছে রাতের অন্ধকার, অথচ আমি কোন আলো দেখছি না। আমার দু’চোখ ছেয়ে যাচ্ছে অচেনা অন্ধকারে। এমন সর্বনাসা সকাল কখনো দেখিনি। আগে ফজরের আযানের সাথে সাথেই মা-বাবা উঠে নামায পড়তেন, আমাদের ডাকতেন, মা কোরআন তেলওয়াত করতেন। বাবা সকালে নদীর পাড়ে হাঁটতে বেরোতেন, আমিও যেতাম বাবার সাথে। বাবা কখনোই আপত্তি করতেন না। সকালের শান্ত ব্রহ্মপুত্র নদ, তার পাড় ঘেঁষে নিরিবিলি লম্বা রাস্তা, বাবার হাত ধরে ভোরের আলোর পথে হাঁটা, সে কী মধুময় দিন! সে কী নির্ভার জীবন।
স্বপ্নের ঘোরের মধ্যে কেটে যাওয়া সময়। ২০১৭ সনে আমি যখন বিদ্যাময়ী স্কুলে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তির সুযোগ পেলাম, বাবার সে কী আনন্দ! বিদ্যাময়ী ময়মনসিংহে মেয়েদের সবচেয়ে ঐতিয্যবাহী ভালো স্কুল। এ স্কুলের ছাত্রীরা নাকি সমাজের বড় বড় জায়গায় প্রতিষ্ঠিত, অনেক বড় বড় মানুষ। বাবার চোখে সে স্বপ্নের বিচ্ছুরণ আমি দেখেছি। বাবা ছোট চাকরি করতেন বলে সবসময়ই চাইতেন, আমি যেনো পড়াশোনা করে অনেক বড় মানুষ হই। বাবা বলতেন, “মা, চেষ্টা আর পরিশ্রম করলে আল্লাহ ফল দিবেনই। আর আমি তো আছিই তোমার যোগালী।”
আর আজ !!
আামাদের সাথে কেউ নেই।
বাবা নেই, মা নেই। পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই। কারো কাছে থাকার আশ্রয় নেই। এই তিনটে মেয়ের বোঝা কে নেবে! আচ্ছা, আমাদের পিইসিই, জেএসসি, এসএসসি পরীক্ষার ফরম ফিলাপে অভিভাবকের জায়গায় স্বাক্ষর করবে কে !! আমাদের নিরাপত্তা দেবে! এ জনপদ এখনো মেয়েদের জন্যে নিরাপদ নয়। এ সমাজ এখনো মেয়েদের মানুষ হিসেবে বাঁচতে দেয়ার যোগ্য হয়ে ওঠেনি। মা-বাবার তত্ত্বাবধানেই যেখানে মেয়েরা নিরাপদ নয়, সেখানে আমাদের মতো বেওয়ারিশ এই তিনটে মেয়েকে কে আগলে রাখবে! চারদিকে ধর্ষণের হিড়িক দেখে মা সারাক্ষণ আমাদের নিয়ে ভীষণ ভয়ে ভয়ে থাকতেন।
নেহায়েত প্রয়োজন না হলে কাউকে বাসায় আনতেন না। সন্ধ্যার পর পরই গেইট লাগিয়ে দিতেন। রাতে কখনোই দরজা খুলতে দিতেন না। অনেকবার জ্যোৎস্না দেখার জন্যে উঠানে যেতে চেয়েছি। মা আপত্তি করেছেন। হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে! তাই তো! তাই জানালা দিয়েই জ্যোৎস্না ছুঁয়েছি। এখন কী হবে মা!
বাবা তুমি কোথায়! তোমার স্বপ্ন – আশারা আজ চোখের জলের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শ্বাপদসংকুল পথে। কে ধরবে হাত! কে দেখাবে পথ! কে ধরবে আলো তিমির রাতে! আমরা কেউ তো অবাধ্য ছিলাম না বাবা, তাহলে এভাবে আমাদের একা করে গেলে কেন!
আযান শেষ হওয়ার পরপরই দু’বাড়িতে ফোন দিয়ে ছিলাম। এই লকডাউনের মধ্যে তারা কেউ আসতে পারবেন না। এখানেই দাফন করে ফেলতে বলেছেন। ফজরের নামায শেষ হলেই আমি মসজিদের হুজুরের কাছে যাব, মার দাফনের ব্যবস্থা করে দেয়ার জন্যে। আমি জানি
ময়মনসিংহ শহরে একদল স্বেচ্ছাসেবক মানবিক মানুষ আছেন, যাঁরা এই করোনাকালে নিজেদের জীবনের মায়া তুচ্ছ করে বহু লাশের দাফনকাফন ও সৎকারের কাজ করে আসছেন। শুনেছি হিন্দু, মুসলমান সবাই আছেন এই দলে। আহারে ধর্ম! দুঃসময়ে তুমি কতো উদার!
মার স্কুলের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক দুজনকে ফোনে জানালাম। মার দীর্ঘদিনের সহকর্মী মরিয়ম খালাম্মা তো কান্নার চুটে কথাই বলতে পাচ্ছেন না। তিনি ঈদে তাঁর বয়স্ক মাকে দেখতে কুঁড়িগ্রামে গেছেন। স্কুলের বন্ধ চলমান থাকায় মার সহকর্মীরা কেউ এখনো শহরে ফিরেননি। মার ব্যাগ খুলে দেখি সেখানে মাত্র শ পাঁচেক টাকা! ব্যাগ থেকে চাবি নিয়ে আলমিরা খুললাম। দেখি সেখানে একটি খামে বিশ হাজার টাকা রাখা আছে। সাথে মার চেক বই, তার তিন- চারটি পাতায় মা স্বাক্ষর করে রেখেছেন! তার পেছনেই পাঁচ লাখ টাকার সন্ঞ্চয়পত্রের কাগজ। বাবা মারা যাবার পর মামাবাড়ি থেকে ও আজমল চাচা মাকে যে দুটো সাদা শাড়ি দিয়েছিলেন সেগুলোও আলমিরার সামনের সারিতে রাখা। মা এসব কবে করলেন! আর সন্ঞ্চয়পত্রের কাগজই বা মা ড্রয়ার থেকে বের করে সামনে রেখেছেন কেন! কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না। হাতে একদম সময় নেই। এতোক্ষণে হয়তো নামায শেষ হয়ে গেছে। হুজুর কোথাও চলে যেতে পারেন কিংবা করোনার কারণে মক্তব বন্ধ থাকায় নামায শেষে হুজুর ঘুমিয়েও যেতে পারেন। এখনো টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। ওদের বলে ছাতাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।
আমার পায়ে যেনো কোন বল নেই।
পথে পথে পা আটকে যাচ্ছে। রাস্তায় সুনসান নীরবতা। আমাদের অদূরবর্তী উঁচু দালানের প্রতিবেশীরা কেউ বোধ হয় এখনো জাগেননি। চিংড়ি মাছের মতো রঙ করা সড়ক ভবনের সারি সারি উঁচু দালানগুলোর গা বেয়ে যেনো আমাদের দুঃখে গড়িয়ে পড়ছে অশ্রু। হঠাৎই বৃষ্টির বেগ বেড়ে গেলো। আমায় তবুও যেতে হবে। প্রায় কাকভেজা হয়ে যখন মসজিদের সামনে পৌঁছেছি, দেখি তখনো চার-পাঁজ্জন মুসুল্লী বারান্দায় দাঁড়িয়ে। মনে হয় বৃষ্টির জন্যে আটকা পড়েছেন। তাঁদের দেখে মনে সাহস পেলাম। আমি তাঁদের সালাম দিয়ে হুজুরের সাথে দেখা করার প্রয়োজনের কথা জানালে তাঁদের একজন ভিতরে গিয়ে হুজুরকে ডেকে আনলেন। আমি হুজুরকে মার কথা জানালাম এবং অনুরোধ করলাম যাতে মার মৃত্যু সংবাদটা মাইকে প্রচার না করেন। মুসল্লীদের একজনের কাছে একজন স্বেচ্ছাসেবকের নম্বর ছিলো। তিনি ফোনে নিশ্চিত করলেন যে, তাঁরা সাতটা সাড়ে সাতটার মধ্যে এসে সব ব্যবস্থা করে দেবেন, আমাকে আর কিছুই করতে হবে না। তাঁদের সাথে নাকি এখন একজন ভদ্র মহিলাও যোগ দিয়েছেন, তিনিই মার ওজু গোসল করাবেন। সেই মুসল্লীদের চোখে আমি সহমর্মিতা ও মানবতার ছাপ লক্ষ্য করলাম। আমি তাড়াতাড়ি ছুটে আসলাম বাড়িতে। মাকে আর বেশিক্ষণ দেখতে পাব না। বাড়িতে এসে মার মুখের পানে অপলক তাকিয়ে রইলাম। মনে হলো, মা যেনো মুচকি হাসছেন। বলছেন,” রাতারাতি বড় হয়ে গেলি মা!” আমি কিছু বলছি না। আমার এখন অনেক দায়িত্ব। বাবার মুখটা শেষে কেমন ছিলো, দেখতে পারিনি, বাবা কোথায় শুয়ে আছেন, কিছুই জানি না। তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, মাকে গণকবরে কবর দেবো না। মা চিরকাল বাড়িতেই থাকবেন আমাদের সাথে। মার প্রিয় শিউলী গাছটার তলায়ই মা থাকবেন। আমরা সারাক্ষণ মার কাছাকাছি থাকবো, মাকে ঘিরে রাখবো।
সাতটা বাজার আগেই স্বেচ্ছাসেবক দল চলে এসেছেন। একটা মিনিট্রাকে তাঁদের সব সরঞ্জাম। তাঁরা সব সাথে করে নিয়েই এসেছেন। সঙ্গে সেই ভদ্রমহিলাও। পর্দানশীন মহিলা, অথচ পুরুষদের সাথে রাতদিন এই মানবতার ফেরি করে বেড়াচ্ছেন! মনে মনে তাঁকে অভিবাদন জানালাম। আমি কবরের জায়গা দেখিয়ে দেয়া মাত্রই তাঁরা কাজে লেগে গেছেন। মাকে গোসল করানোর জন্য খাটিয়ার চৌকির চারপাশে ভারী কাপড়ের পর্দা টানিয়ে দিয়েছেন। কী করিৎকর্মা একেকজন! মুখে তেমন কথা নেই, অথচ সব কাজ যেনো মুখস্থ! আমরা তিনবোন ঐ ভদ্রমহিলার নির্দেশে তাঁর সাথে রবোটের মতো কাজ করছি। দায়িত্ব মুহূর্তের মধ্যে আমাদের কান্না ভুলিয়ে দিয়েছে! মার প্রতি কর্তব্যই আমাদের কাছে বড় হয়ে উঠেছে। নয় বছরের ঋতুও যেনো এ বিষয়ে অনেক অভিজ্ঞ। অথচ এর আগে আমরা খুব কাছে থেকে কারো মৃত্যুই দেখিনি! জীবন বুঝি এভাবেই মানুষকে হঠাৎ কঠোর বাস্তবতার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়! জানি না। ভদ্রমহিলা কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমাদের সাথে কথা বলছেন। বললেন, “বাসায় তো আর কাউকে দেখছি না! আত্মীয় স্বজন কেউ আসেননি? ” তিনজনই একসাথে মাথা নাড়লাম। উনি নুয়ে কাজ করছিলেন, তাই হয়তো আমাদের মাথা নাড়ানো দেখেননি। নীরবতায় বুঝে নিয়েছেন। আমি তাঁকে বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে, মা তাঁর সাদা শাড়ি দুটো কী ভেবে আলমিরার সামনে রেখেছিলেন, এগুলো দিয়ে কাফনের কাপড় হবে কি না! উনি বললেন, এগুলো পাতলা কাপড়, বৃষ্টির দিন,
ভিজে গা দেখা যেতে পারে। তাঁরা সঙ্গে করে কাপড় নিয়ে এসেছেন। গোসল শেষে মার গা মুছে তাঁদের সাথে আনা কাপড় মাকে পরিয়ে দিচ্ছেন, আমরাও সহযোগিতা করছি। আমরা মার মুখ না ঢাকার জন্য তাঁকে অনুরোধ করলাম। উনি বুঝলেন। বৃষ্টি বাতাসে আগরবাতি নিভে গিয়েছিল। মিতু নিজে থেকেই আবার আগরবাতি জ্বালিয়ে আনলো। খাটিয়ার উপরে একটা নতুন চাদর এনে বিছিয়ে দিলো যাতে মার গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা না পড়ে। উনি মার গায়ে গোলাপজল ছিটিয়ে দিলেন, সেটা এসে আমার গায়েও লাগলো। মনে হলো, মা যেনো ছুঁয়ে দিলেন আমায়। ততক্ষণে কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। ওজু করে তাঁদের একজন জানাযার জন্যে হুজুরকে ডাকতে গেলেন। ইতোমধ্যে বাকীরাও হাতমুখ ধুয়ে ওজু করে নিয়েছেন।
এরই ফাঁকে আমরাও তাড়াতাড়ি গায়ে পানি দিয়ে ধোয়া জামাকাপড় পরে ওজু করে নিলাম। মার মৃত্যু সংবাদ মাইকে প্রচার না করায় জানাযায় তেমন কেউই এলো না। গলির মোড়ের দোকানদার চাচা, মার স্কুলের দপ্তরী ও সকালের মুসুল্লীদের দু’জনকে দেখলাম। শুনেছি আজকাল করোনার ডরে মানুষ নাকি জানাযায়ও যায় না। ভদ্রমহিলা জানতে চাইলেন, রাতে আমাদের সাথে কেউ থাকবে কি না! আমি মুখ নীচু করে রইলাম। উনি আমার মাথায় হাত রেখে কিছুক্ষণ নির্বাক তাকিয়ে থাকলেন। মাকে কবরে নামানো পর্যন্ত আমরা স্থির ছিলাম। কিন্তু বাঁশের ফালার উপরে যখন বাঁশের চাটি দিয়ে চিরতরে মাকে ঢেকে দিচ্ছিলেন, তখন আমাদের আর্ত চিৎকারে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হয়ে যাচ্ছিলো। ঋতু দৌড়ে গিয়ে তাঁদের বাধা দিতে লাগলো। তাঁদের একজন জোর করে ঋতুকে সরিয়ে নিয়ে গেলেন। ঐ ভদ্রমহিলা তার বুকের সাথে আমাদের শক্ত করে জড়িয়ে ধরলেন। আমি চোখ বন্ধ করে রইলাম। মাকে চিরদিনের জন্য ঢেকে দেয়া সহ্য করতে পারছিলাম না। দাঁতে দাঁত চেপে থরথর করে কাঁপছিলাম। ভয়ে, তাকাতে পারিনি। আমাকে ঝাঁকুনি দিয়ে ভদ্রমহিলা জানালেন, তাঁদের আবার ডাক পড়েছে অন্য খানে, এখুনি ছুটতে হবে। তাই
স্বেচ্ছাসেবকরা হাতের কাছে যা-ই পেয়েছেন তাই দিয়ে একটা বেড়ার মতো দাঁড় করিয়েছেন। মার বুকের উপর খেজুর পাতা বিছিয়ে দিয়েছেন। আমাদের কাছ থেকে বিদায় চাচ্ছেন। ভদ্রমহিলা তখনো আমাদের বুকে জড়িয়ে ধরে আছেন। কী বলবো একে! কী নাম দেবো এই অচেনা স্নেহের! ওদিক থেকে তাগিদ আসছে, তাঁকেও যে যেতে হবে! উনি বললেন,
ঘরে তাঁর বয়স্ক মা, আবার এই কাজে তাঁকে
যখন তখন যেখানে সেখানে ছুটতে হয়। না হয় আজ রাতটা আমাদের সাথে থেকে যেতেন। আমি মার ব্যাগ থেকে কিছু টাকা এনে তাঁর হাত ধরে বললাম, খালা……..। তিনি তিনি টাকা নিতে রাজি হলেন না। বললেন, করোনাকালে জীবন বাজি রেখে এই কাজ করছেন মানবিক দায় থেকে,
টাকার জন্যে নয়। তাঁর মানবিকতার কাছে নত হয়ে রইলাম। স্বেচ্ছাসেবকরা ট্রাকের ভাড়াটা পর্যন্ত নিলেন না। বললেন, এজন্য ফান্ড আছে। তাঁরা নিমিষে ট্রাক নিয়ে চললেন অন্য গন্তব্যে। আমি ট্রাকের পিছনের পানি ছিটানোর দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম। কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ। কোথাও কোন আলোর সম্ভাবনা নেই। ঋতু এখনো মার কবরের পাশে ঠাঁয় বসে আছে। তখনো থেমে থেমে হালকা
বৃষ্টি পড়ছে। মিতু টানাটানি করেও ঋতুকে ঘরে আনতে পারেনি। ডাইনিং টেবিলের ক্লথটা টেনে তুলে নিয়ে মিতু মার গায়ে দেয়ার চেষ্টা করছে,যেনো মায়ের গায়ে বৃষ্টি না পড়ে। আমি বারান্দার বেন্ঞ্চটাতে বসে নির্বাক মায়ের দিকে তাকিয়ে আছি। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। আমাদের সময় কাটছে নিদারুণ জড়তায়। পৃথিবীতে মানুষ কতো অসহায়, কতো একা! হঠাৎ মনে হলো, আমার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী শাহানার
মাকে একবার অনুরোধ করে দেখি। আমি ফোন দিয়ে খালাম্মাকে অনুরোধ করলাম, উনি যেনো শাহানাকে নিয়ে আজকের রাতটা অন্ততঃ আমাদের সাথে থাকেন। এর আগেও খালাম্মা শাহানাকে নিয়ে আমাদের বাসায় কতবার থেকেছেন। খালাম্মা বললেন, খালুর সাথে কথা বলে এক্ষুনি জানাচ্ছেন। খুব আশা করে অপেক্ষা করছি। খালাম্মা জানানোর আগেই আমি ফোনে খালুর হুঁন্কার শুনলাম। আমি ফোনটা কেটে দিয়ে বসে রইলাম। মিতু,ঋতু আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ওদের থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। ভাবছি, আমি কেন এই বোকামিটা করতে গেলাম! এমন দিনে করোনা সন্দেহে মৃত মানুষের বাসায় কেউ আসে! প্রতিদিন দুশর উপরে মানুষ মারা যাচ্ছে। যদিও এই গণণায় আমার মার মতো অনেকেরই হিসেব নেই। আগে ভয় না পেলেও এখন রীতিমতো তটস্থ মানুষ। ভ্যাক্সিন নেয়ার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সবাই। আগে পার্শ্ব প্রতিক্রিয়ার ভয়ে অনেক শিক্ষিত মানুষও টিকা নিতে চাইতন না। চল্লিশ না হওয়ায় মা তো টিকা নেয়ার সুযোগই পাননি।
আজ যেনো সন্ধ্যা নেমে আসছে সন্ধ্যারও আগে। শ্রাবণের মেঘাচ্ছন্ন আকাশ যেনো আমাদের মতো ভারাক্রান্ত মনে ভর করেছে। হঠাৎ গেইটে কে জানি কড়া নাড়ছে। মিতু- ঋতু এসে জড়িয়ে ধরেছে আমাকে। ভয়ে আমার হাত,পা কাঁপছে। তবুও ওদের সাহস দিয়ে বললাম, তোরা ভিতর থেকে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বসে থাক, আমি দেখছি। ওড়নার নীচে ছোট বটিটা লুকিয়ে নিয়ে গেইটের কাছে গেলাম। আমি কে, কে, করছি, ওপাশের জবাব আমার কানেই আসছে না। আমার মাথা, কান আগুন গরম হয়ে গেছে। কড়া নেড়েই চলছে। বটি হাতে নিয়েই গেইট খুলতে গেলাম। দেখি সেই স্বেচ্ছাসেবকদের একজন। আমাদের জন্য কিছু খাবার নিয়ে এসেছেন। সাথে গলির মোড়ের দোকানদার চাচা, তাঁর হাতে কলা, পাউরুটি, বিস্কুট ও একবোতল পানি। আমি বটি হাতে লজ্জা পেয়েছি দেখে স্বেচ্ছাসেবক বললেন, “আপনাদের তো সারাদিন কিছু খাওয়া হয়নি!তাই এখানে সামান্য খাবার।”
দোকানদার চাচাও মাথা ঝাঁকালেন। যাবার বেলায় তাঁরা দু’জনেই তাঁদের ফোন নম্বর দিয়ে বললেন, দিন কিংবা রাতে কোন অসুবিধায় পড়লেই যেনো তাঁদের ফোন দিই। কী ভয়টাই না পেয়েছিলাম! যাক, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
আমি ঘরে ঢুকতেই ঋতু খাবারগুলো খোলে দেখতে লাগলো। আমার দিকে তাকাতেই মাথা নাড়িয়ে সায় দিলাম। ছোট মানুষ সারাটাদিন না খেয়ে আছে। কাঁদতে কাঁদতে এখন আর কথা বলতে পাচ্ছে না । সে মিতুকেও টানলো। মিতু নড়লো না। মার বিছানায় যেমন বসে ছিলো, তেমনি বসে রইলো। সন্ধ্যা ঘনায়ে আসছে ক্রমশ। শ্রাবণদিনের বর্ষণমুখর সন্ধ্যা যেনো রাতের মতোই অন্ধকার। গেইটটা ঠিকমতো লাগালাম কি না আবার চেক করলাম। এই শহরের পনেরো- বিশজন মানুষ ব্যতীত কেউ জানে না যে, মা নেই। তাহলে আমার এতো ভয় করছে কেন! গতকাল সারারাত তো একটুও ভয় করেনি! মৃত হোক,
মা তো পাশে ছিলেন। কালকের সন্ধ্যা আর আজকের সন্ধ্যায় কত তফাত! মাত্র একটা দিনের ব্যবধানে লন্ডভন্ড হয়ে গেলো আমাদের স্বাভাবিক,সাবলীল জীবন! আজ হঠাৎ কারেন্ট চলে গেলে! বাজ পড়লে! বিদ্যুৎ চমকালে! রাতেরবেলা কেউ গেইটে নক করলে! দেয়াল টপকে এসে দরজায় নক করলে! কার কাছে ছুটে যাব আমরা!! কাকে জড়িয়ে ধরবো!! কে অভয় দেবে!! সন্ধ্যা ঘনায়ে যতোই ধেয়ে আসছে রাত
দু’বোনকে বুকের সাথে শক্তভাবে জড়ায়ে
ধরে ততোই কুঁকড়ে যাচ্ছি আমি।
এখন কোথায় যাব!!
কাকে আশ্রয় করে বাঁচবো!!!
কালেক্ট -অনির্বান লাইব্রেরি গ্রুপ।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি