গল্প
একটু_সহমর্মিতা
লেখক – জান্নাতুল ফেরদৌস আলেয়া।
জেলা ও দায়রা জজ।
সম্পাদনায় -ফরজুন আক্তার মনি
সম্পাদক ও প্রকাশক-(দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ নিউজ টিভি. কম)।
আমার বড় বউমা এবার সমাজ সেবায়
উপজেলা লেবেলে পুরস্কার পেয়েছে। এ নিয়ে ক’দিন ধরেই বাড়িতে খুব হৈচৈ চলছে। পাড়ার অনেকেই ফুল নিয়ে শুভেচ্ছা জানাতে এসেছে। শুনেছি পাড়ার মহিলা ক্লাব থেকে তাকে সংবর্ধনাও দেবে।
অনেকেই তাকে এবার কাউন্সিলর পদে দাঁড়ানোর জন্যে উৎসাহিত করছে। আর বউমা তো এক পায়ে খাড়া।
করোনার জন্যে নির্বাচন বন্ধ ছিলো। সে কারণে প্রচারণায়ও ছিলো লকডাউন। কিন্তু হঠাৎ আবার নির্বাচনের তুমুল হাওয়া বইতে শুরু করেছে। রাত নেই, দিন নেই অবিরাম প্রচারণা চলছে। মাইকের আওয়াজে কান পাতা যায় না।
আমার পাঁচ ছেলেমেয়ে।
সবাই উচ্চ শিক্ষিত। তিনছেলে ভালো চাকরি করে, বড়ছেলে ব্যবসা করে। চার ছেলেই দেশে থাকে। মেয়েটা জামাইয়ের সাথে কানাডায় সেটেল্ড। মাশাআল্লাহ সবাই
ভালো আছে। ওদের বাবা যখন লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়ে মারা যান, তখন বড় ছেলেটা নবম শ্রেণিতে, আর মেয়েটার
তখন তিন। চিকিৎসায় সন্ঞ্চয় সব শেষ,
সামান্য যা পেনসন পেয়েছিলাম তা দিয়ে ঋণ মিটানোই সম্ভব হয়নি। সম্বল শুধু আমার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকতার চাকরিটা। তখন প্রাইভেট পড়ানো,
কোচিং এর এতো প্রচলন ছিলো না।
আমার শখের সেলাই মেশিনটা তখন খুব কাজে দিয়েছিল। সারাবছর আশেপাশের সবার জামাকাপড় সেলাই করতাম। একটু
ডিজাইন, লেইচ লাগিয়ে, সামান্য একটু হাতের কাজ মিলিয়ে সেলাই করতাম বলে
সবাই আমার কাছেই আসতো। আর ঈদে,
পূজায় রাতদিন সেলাই করতাম। এই অতিরিক্ত আয় জমিয়ে গ্রামে পন্ঞ্চাশ শতক জমি কিনেছিলাম। সেখান থেকেই সারাবছরের চাল পেয়ে যেতাম। আমার পেনসনের টাকায় গ্রামের বাড়িটি মেরামত করেছি। বাকী টাকা ছেলেদের হাতেই তুলে দিয়েছি।
বয়স হয়েছে বলে এখন আর তেমন চলাফেরা করতে পারি না। হাত,পা কাঁপে।
হাঁটু আর কোমড়ের হাড়ও নাকি ক্ষয়ে গেছে। তাই খুব ভয়ে ভয়ে থাকি। কিন্তু ভয়েই বাড়ে ভয়। গত মাস তিনেক আগে
পড়ে গিয়ে আমার হিপজয়েন্ট নড়ে গেছে।
এখন আর দাঁড়াতে পারি না, বসতেও পারি না। করোনা ও বয়সের কারণে অপারেশনও করা যায়নি। মেয়েটা রোজই ফোনে কান্নাকাটি করছে। কিন্তু আসতে পাচ্ছে না। এখন আমাকে মেইনটেইন করা সত্যি কঠিন। তাই আমার ছেলেরা ঠিক করেছে আমাকে তিন মাস করে একেকজনের কাছে রাখবে। বউমাদের কানাঘুঁষা শুনছি। আমার বলার কিছু নেই।
আমার চাকরিজীবী তিন ছেলেই ঢাকায় থাকে। তবে কর্মস্থলের কারণে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায়। তিন বউমাই কর্মজীবী। আধুনিক, স্মার্ট পরিবার। বাসায় স্থায়ী কাজের মানুষ রাখেনা কেউ। প্রায় প্রতি
সপ্তাহেই সপরিবারে কোথাও না কোথাও বেড়াতে চলে যায়। যখন তখন বাইরে খেতে যায়, কিংবা প্রায়ই বাইরে থেকে খাবার নিয়ে আসে। বাচ্চাদের স্কুলের অনুষ্ঠান,
অফিসের পার্টি, সভা, সেমিনার লেগেই থাকে সারাবছর। করোনার কারণে আপাততঃ সবই প্রায় বন্ধ।
আমার বড় বউমা চাকরি করে না।
তবে সমাজ কর্ম করে বেড়ায়। বিভিন্ন সংগঠনের সাথে যুক্ত থাকে। নানাকাজে
তাকে প্রায় সময়ই বাসার বাইরে যেতে হয় বলে তার বাসায় স্থায়ী কাজের মানুষ আছে। আমি যতোদিন কর্মক্ষম ছিলাম,
তখন, যখন যে ছেলের বাসায় প্রয়োজন
হতো সেখানেই দৌড়ে যেতাম। নাতিরাও তখন ছোট ছিলো। আমি বাসায় থাকলে সবাই ভরসা পেতো।বউমাদের মধ্যে তখন
রীতিমতো কাড়াকাড়ি চলতো আমাকে নিয়ে। নিজের গুরুত্বের কথা ভেবে মনে মনে আমার বেশ গর্ব হতো। নাতি- নাতনিরা
তখন আমাকে ছাড়া কিছু বুঝতোই না। কতো গল্প শুনতে চাইতো! তাদের সমস্ত আবদার ছিলো তখন আমার কাছে। কে কি খাবে, কি টিফিন নিবে সবই আমাকে বলতো। তাদের মা-বাবারা এসব নিয়ে চিন্তাই করতো না। ছোটা কাজের বুয়া
আসলে সকালে তাকে দরজা খুলে দেয়া,
সারাদিন তার পিছন পিছন ঘরের যাবতীয় জিনিস পাহারা দেয়া ছিলো আমার নিত্য কর্ম। তখন বউমারাও আমার রান্নার খুব প্রশংসা করতো। আমিও অত্যন্ত খুশি মনে
সব রান্না করতাম। এ ছেলের বাসা থেকে সে ছেলের বাসায় ছুটে বেড়াতাম। যেনো আমি এডিসি জেনারেল। সবার সব সুবিধা অসুবিধা আমাকে দেখতে হবে, সমন্বয় করতে হবে। এক ছেলের বাসা থেকে আরেক ছেলের বাসায় যাবার সময় নাতিরা কান্নাকাটি করতো, বউমাও মন খারাপ করতো। এসব দেখে আমারও ভীষণ মন খারাপ লাগতো। কিন্তু আমাকে তো রানারের মতো প্রয়োজন মতো পৌঁছাতে হবে। তাই এসব ভেবে সময় নষ্ট করার সময় কোথায়! রানার ছুটেছে রানার, এ বাসা থেকে সে বাসার কাজে গতি আনার।
আমাকে দেখেই বউমার চোখেমুখে উপচানো খুশি। মা এসে গেছে। এখন আর কোন চিন্তা নেই। একেক বউমা আমাকে পাবার জন্যে অপেক্ষা করতো। তখন কতো কদর ছিলো আমার! হাঁটুর ব্যথায়, কোমড়ের ব্যথায়, বয়সের ভারে যখন থেকে আমি স্বাভাবিক ভাবে চলাফেরাই
করতে পারি না তখন থেকে আমাকে দেখে কেউ খুশি হয় না। নাতিরাও বড় হয়েছে, তারা তাদের পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত। কতো অসুবিধা আমি বাসায় থাকলে। আগে আমি বাসা পাহারা দিতাম, এখন আমাকে পাহারা দিতে হয়। আগে আমি সেবা দিতাম, এখন আমাকে সেবা দিতে হয়। আমার জন্য বাসায় লোক রাখতে হয়। স্থায়ী লোক পাওয়া যায় না এখন। সবাই গার্মেন্টসে
চাকরি করে। বাসা বাড়ির কাজ করতে কেউ চায় না। এতে তাদের আত্মমঅযাদা থাকে না। গার্মন্টেসে চাকরি করার যোগ্যতা যাদের নেই, তারাই বাসায় বাসায় ছোটা কাজ করে। আমি বাসায় থাকলে তারা বাইরে ডিনারে যেতে পারে না, বাচ্চাদের স্কুলের, অফিসের পিকনিকে যেতে পারে না। দু-একদিনের জন্যেও কোথাও ঘুরতে যেতে পারে না। এসব অসুবিধা দেখে আমারও ভীষণ খারাপ লাগে। কিন্তু কী করবো বুঝে উঠতে পারি না। প্রতিমুহূর্তের
অসহায়ত্ব, উপেক্ষা, অবজ্ঞা, অবহেলা আমার মর্মে এসে বাজে। কিন্তু কিছুই করতে পারি না।
এরই মধ্যে হঠাৎ কী হলো জানি না। বড়
বউমা আমাকে তার কাছে নিয়ে যেতে এসেছে। আমি কিছুই বুঝতে পাচ্ছি না।
মেজো বউমা যেনো হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো।
আমার এখন মতামতের কোন অবকাশ নেই। চলে এলাম পুরাতন মফস্বল শহরে।
পুরোনো পথের গন্ধে আমিও যেনো এক প্রকার খুশি খুশি ভাব অনু্ভব করলাম।
কয়েকদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম আমার বড় ছেলের ছেলেটা কানাডায় পড়তে যাবে, আমার মেয়ের ওখানেই থাকবে। আর আমার মেয়েটা আমাকে অন্ধের মতো ভালবাসে। আমি বড় বউমার কাছে আছি জেনে আমার মেয়েটা মহোৎসবে ভাইপোর যাবার আয়োজন করছে। বড় বউমা প্রায়ই আমার মেয়ের সাথে আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিচ্ছে।
কী শান্তি, কী শান্তি।
কিন্তু মুশকিল হলো হঠাৎ পড়ে গিয়ে শয্যাসায়ী হওয়ায়। এদিকে বড় বউমার
ইলেকশন, দিনরাত ছুটাছুটি। লোকজন
অনবরত বাসায় আসছে, যাচ্ছে। কাজের
মহিলা তাদের তাবেদারী করেই কুলিয়ে উঠতে পাচ্ছে না। এতো এতো লোকের রান্নাবান্না, চা,নাস্তা। বউমা সেই সকালে বেরিয়ে যায়, মধ্যে রাতে ফেরে। এতোসব ব্যস্ততার ফাঁকে আমিই কেবল পড়ে থাকি অলক্ষ্যে। আমি যে একটা মানুষ, ঘরের এককোণে পড়ে আছি সারাক্ষণ,
সেদিকে কারো খেয়ালই নেই। নিজে নিজে নড়তেও পারি না আর। প্রতিদিন মন খারাপ করে পড়ে থাকি চোখ বুজে। কিন্তু দিন যেনো আর শেষ হতে চায় না। একদিন
বড় ছেলেকে বুঝিয়ে বললাম, আমাকে কোন বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসতে। শুনেই বড়
বউমা গুরুতর আপত্তি জানালো। সামনেই নির্বাচন , এ সময়ে এমন কিছু করলে লোকে বউমার সমাজ সেবা নিয়ে হাসাহাসি করবে না! তা তো আর হতে দেয়া যায় না।
সমাজ সেবার কারণেই বউমা এবার নির্বাচনে জিতবে। সবাই তা বলছে। সমাজের সেবক হিসেবে বউমার কতো সুনাম। কতো সভা- সমিতিতে বউমা কতো সুন্দর সুন্দর বক্তব্য দেয়। পরিবারের বয়স্কদের প্রতি মানবিক আচরণ করতে হবে, শিশুদের মতো লালন পালন করতে হবে, নিত্য তাদের সুবিধা অসুবিধা জানতে হবে, তাদের ভালো রাখার চেষ্টা করতে হবে। শুনে কতো মানুষ হাততালি দেয়।আরো কতো ভালো ভালো কথা বলে। মাঝে মাঝে এসব বক্তব্যে ভিডিও ফোনে ধারণ করে এনে বাসার সবাইকে দেখায়।
আমাকে কেউ দেখায় না। কাজের মেয়েটা মাঝে মাঝে এসে আমার কাছে গল্প করে।
আমি মনে মনে হাসি। অথচ বাস্তবে বড় বউমা সাতদিনেও একবার আমার রুমের
ধারে কাছেও আসে না। পরিচিত কেউ আমার সাথে দেখা করতে আমার রুমের দিকে আসতে চাইলে বড় বউমা বলে, মা এ সময়টাতে ঘুমায়। আমি শুনেও কিছু বলি না। তিনমাসের মধ্যেই কতো অসুবিধা।
জানি না আরো কতো তিনমাস বাঁচবো। বাকী জীবন কাটাবো কী করে! মানুষ স্বভাবতই বাঁচতে চায়। কিন্তু এমন বাঁচা কারো কাম্য নয়।
জীবন, মৃত্যু মানুষের হাতে নেই। কিন্তু একটু সহানুভূতি তো মানুষ পেতেই পারে!
পারে না !!
“””””””””””””””””””””””'”‘”””””””'”””””””””
২সেপ্টেম্বর, ২০২১
“””””””””””””””””””””””””””””””””””””””
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি