ষ্টাফ রিপোর্টার।
ইট বসানো আঁকাবাঁকা মেঠো পথের দুপাশ জুড়ে গাঢ় সবুজের মিছিল। গ্রামের বুক চিরে যাওয়া নির্জন একটি সড়ক গ্রামটিকে যুক্ত করছে তিন উপজেলার সঙ্গে। এখানে প্রকৃতি যেন তার সব রূপ উজাড় করে দিয়েছে। ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে পাল্টে যায় রূপ-বৈচিত্র্য। গ্রামের পশ্চিমে রয়েছে পানির ওপর ভাসমান দুটি ভূখণ্ড। সবুজ গাছে ঘেরা ভূখণ্ড বা দ্বীপের চারদিকে পানি থই থই করে।
দুই দ্বীপে অন্তত ৩০টি পরিবার বসবাস করে। এখানেই রয়েছে ১০ শতাংশ জায়গার ওপর প্রায় শত বছরের পুরনো একটি আমগাছ। গ্রামের মানুষ কখনও কৃষক, কখনও জেলে আবার কখনও মাঝি। এমন একটি গ্রামের নাম দমদমা। যা কাপাসিয়া, শ্রীপুর ও কালীগঞ্জ তিন উপজেলার মোহনায় অবস্থিত।
যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করে তিন উপজেলার সঙ্গেই গ্রামের মানুষের নিবিড় সম্পর্ক। তার মধ্যে কাপাসিয়া অন্যতম। কাপাসিয়া সদর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এ গ্রামের চারদিকে পাখির কলতানি। কখনও কখনও সুনসান নীরবতা। পথ দিয়ে একা একা চললে দুরদুর করে উঠবে বুকের ভেতরটা।
গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা কৃষি হলেও এখানকার বৃহৎ অংশই প্রবাসী। স্থানীয় একটি দাখিল মাদ্রাসা ছাড়া মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় শিক্ষাব্যবস্থার তেমন উন্নয়ন ঘটেনি। গ্রামের ভেতর দিয়ে আঁকাবাঁকা সড়কগুলোয় ইট বসানো। আবার কোথাও কোথাও কাঁচা সড়কও রয়েছে। হাটবাজার বা দোকানপাট দূরে হওয়ায় মানুষকে কষ্ট পোহাতে হয়।গ্রামের ভেতরে সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে পানির মধ্যে ভাসমান দুটি দ্বীপ। যেখানে কয়েকটি পরিবার মিলেমিশে বসবাস করে। শুধু দুটি দ্বীপই নয় এখানে আরও অনেক দ্বীপ বর্ষার ভরা মৌসুমে টইটম্বুর পানিতে মাথা নাড়া দিয়ে জেগে উঠে। আকর্ষণীয় ভাসমান দ্বীপ দুটি মৃধা বাড়ি নামে পরিচিত। বর্ষার ভরা মৌসুমে চারপাশে থই থই পানিতে ডুবে যাওয়া টাইটানিকের মতো ভেসে থাকে ভাসমান এ ভূখণ্ডটি।কয়েক বছর আগেও বর্ষা মৌসুমে সেখানে যাওয়ার একমাত্র মাধ্যম ছিল ছোট ডিঙি নৌকা। অর্ধ কিলোমিটার দূর থেকে ইশারার মাধ্যমে সঙ্কেত দিয়ে চলাচল করত মানুষ। মানুষের ভোগান্তির কথা চিন্তা করে কয়েক বছর আগে ছোট একটি সংযোগ সড়ক নির্মাণ করার সে চিত্র কিছুটা পাল্টে গেছে। তবে এখনও পাল্টেনি গ্রামের মানুষের কর্মব্যস্ত জীবন।বর্ষায় গ্রামের কৃষকরা হয়ে উঠে জেলে। সারা দিন চলে মাছ ধরার ধুম। সন্ধ্যায় বাড়ির পাশে পাতা হয় মাছ ধরার জাল। জালে ধরা পড়া মাছ দেখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ডিঙি চালাতে পারে পরিবারের এমন যে কেউ। পানি থেকে তোলা হয় লাল-সাদা শাপলা ফুল। বাড়িতে রান্না করা হয় সে ফুল। মাঝে মাঝে বাজারেও বিক্রি করা হয়। পানি কমতে শুরু করলে ছোট-বড় ডোবা ও ক্ষেত থেকে সেচ দিয়ে মানুষ মাছ ধরতে শুরু করে। জমিতে ধান গাছ রোপণের উপযোগী করার জন্য পানিতে ভেসে আসা কচুরিপানা জমাট বেঁধে ওপরে তোলে গ্রামের কৃষকরা। ওই সময় মাছ খেতে হাজার হাজার সাদা বকের দল ভিড় জমায়।সন্ধ্যা হলে দ্বীপের বাঁশ ঝারে তারা বাসা বাঁধে। তখন গ্রামের ছোট ছেলেরা ছিমছাম রাতের অন্ধকারে বক শিকারে বাঁশ ঝাড়ে লাইট নিয়ে ঘুরে। এক দ্বীপে বকের ডানার ঝাপটানি, অন্যটিতে পাখির কিচিরমিচির কলতানিতে মনে হবে দুটি দ্বীপই যেন পাখিরা শাসন করছে। তবে তাদের মনে বড্ড ভয়। মানুষের আওয়াজ পেলেই ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়।এখানেই রয়েছে বিশাল বড় আকারের একটি আম গাছ। গাছটির মালিক নূরউদ্দিন মৃধা। তার কাছ থেকে জানা যায়, প্রতিবছর এই গাছের আম একবারে পাইকারদের কাছে ২০-২৫ হাজার টাকা বিক্রি করা হয়। খুচরাভাবে নিজে বিক্রি করলে আনেক বেশি টাকা বিক্রি করা যাবে বলে তার দাবি। কত পথিক তার ক্লান্তির অবসান খোঁজেছে এ গাছের ছায়ায় তার হিসাব নেই। কঠোর পরিশ্রমের পর বা তীব্র রোদে এ গাছের নিচে বসে মানুষ প্রশান্তি খোঁজে। বসার জন্যও রয়েছে সুব্যবস্থা।বৈশাখে পুরো গ্রামজুড়ে লাগে ধান মড়াইয়ের উৎসব। পরিবারের সবাই মিলে সারা দিন রোদে পুড়ে বা বৃষ্টিতে ভিজে মাঠ থেকে গোলায় ধান তোলে। একজন কৃষক ২শ থেকে ৩শ মণ ধান পায়। গোলা ভরে যায় ধানে। কৃষকের সারা বছরের সব ক্লান্তি ভুলে মুখে ফুটে উঠে হাসি। গোলা থেকে অল্প অল্প করে ধান বিক্রি করে চলে সংসার ও সন্তানের পড়ালেখার খরচ। শীতে কৃষাণীরা ব্যস্ত থাকে বাড়ির পাশে সবজি চাষে। কৃষকরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খেজুর বা তাল গাছের রস সংগ্রহ করার কাজে।শিল্পীর নিজের হাতে আঁকা ছবির মতো গ্রাম যেন দমদমা। প্রকৃতি নিজেকে উজাড় করে দিয়েছে এখানে। প্রকৃতিপ্রেমী যেকোনো ব্যক্তিকেই বারবার হাতছানি দিয়ে ডাকবে এ গ্রামের মনোমুগ্ধকর নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ। গ্রামের মানুষের অতিথি পরায়ণতাও যেন কোনোভাবে ভুলার মতো নয়।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি