ফরজুন আক্তার মনি :-২০০২ সালের জানুয়ারি, ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের এক ছাত্রীর হার্টের দুটি ভালভ নষ্ট হয়ে যায়।তার ডাবল ভালভ সার্জারির প্রয়োজন। প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা টাকা যোগাড় করে চিকিৎসার জন্য তাকে সিকদার মেডিকেলে নিয়ে যায়।সিঙ্গাপুর থেকে সি এন লি নামে একজন সার্জন আসেন। তাকে বলা হলো, ‘এ মেয়ের সার্জারি তোমাকেই করতে হবে।’
লাইসেন্স না থাকায় লি অপারগতা জানান।পরে চিফ সার্জন ভারতীয় দিলীপ মিশ্রকে বলা হলো।তিনিও রাজি হলেন না।পরে তাকে আমার সঙ্গে থাকার অনুরোধ করি।পরদিন অপারেশন থিয়েটারে তার আসতে দেরি হয়।আমার প্রধান অ্যানেস্থেসিওলজিস্ট মেজর মুজিব জানান,অপারেশন শুরু করুন,দিলীপ আসবে। পরে জানলাম,দিলীপ আগের রাতেই ভারতে পালিয়ে যান।
কথাগুলো গণমাধ্যমে জানিয়েছেন ডা. লুৎফর রহমান।তার নেতৃত্বে সম্প্রতি ল্যাবএইড হাসপাতাল হৃদরোগ-সংক্রান্ত ১২ হাজার সফল অস্ত্রোপচারের মাইলফলক ছুঁয়েছে। ডা. লুৎফর ল্যাবএইডে ১২ হাজার ও সিকদার মেডিকেলে ৩ হাজার,মোট ১৫ হাজার অস্ত্রোপচারের অনন্য মাইলফলক ছুঁয়েছেন। সম্প্রতি দেশ রূপান্তরের মুখোমুখি হয়েছিলেন প্রথিতযশা এ কার্ডিয়াক সার্জন।
ডা. লুৎফর রহমান বলেন, ‘এটাই ছিল আমার প্রথম জটিল সার্জারি।অপারেশন থিয়েটারে মেজর মুজিব ও টিমের অন্য সদস্যরা আমাকে সাহস জুগিয়েছিলেন। সেই অপারেশনটি সফল হয়েছিল।আমি অপারেশন থিয়েটার থেকে বের হয়ে এ খবর জানাতেই শিক্ষার্থীদের সে কী উচ্ছ্বাস।আজও চোখ বন্ধ করলে সে দৃশ্য দেখতে পাই।সার্জারিতে মেয়েটি মারা গেলে ছাত্ররা তাকে পেটাবে এ ভয়ে দিলীপ দেশে ফিরে যান এবং আর কখনো ফিরে আসেননি।’
চিফ সার্জন দিলীপের চলে যাওয়ায় ডা. লুৎফরের বড় চিকিৎসক হওয়ার দ্বার উন্মোচিত হয়।দিলীপের শূন্য পদে হাসপাতাল-মালিক জয়নুল হক সিকদার তাকে দায়িত্ব দেন।এর জন্য তাকে পরীক্ষা দিতে হয়েছে সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ টিমের কাছে।এরপর সিকদার হাসপাতাল হয়ে ল্যাবএইড কেটে গেছে ২২ বছর। একসময় হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের বিদেশে নেওয়া হতো,মানুষের ভরসা তখনো দেশের ডাক্তাররা হয়ে ওঠেননি।এখন দেশেই জটিল সব অপারেশন হচ্ছে।দেশের বড় বড় রাজনীতিক,আমলা, ব্যবসায়ী,কবি ও লেখকদের হার্টে ছুরি চালাচ্ছেন ডা. লুৎফর রহমান।কবি নির্মলেন্দু গুণের হার্টের সার্জারিও করেছিলেন তিনি।
তিনি বলেন, ‘গুণদা খুব রসিক মানুষ।অপারেশন থিয়েটারে গুণদাকে বললাম, দাদা টেনশন করবেন না। গুণদা বললেন, “সমস্যা হচ্ছে, হার্ট একটাই। সেখানে আবার তুমি ছুরি-কাঁচি চালাবা”!’
ডা. লুৎফর বলেন, ‘পেছন ফিরে তাকালে অনেক কথা মনে পড়ে।নিজের সঙ্গে লড়াই করতে করতে আজকের এ অবস্থানে এসেছি।বর্তমানের আমি হয়ে উঠতে দিনের পর দিন যন্ত্রণা সহ্য করেছি।পেশাগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছি।ওরা ছোট দেশের চিকিৎসক বলে অবহেলা করত,বাইরের দেশের রোগীদের স্পর্শ করা যেত না,দূর থেকে দেখতে হতো।’ কিন্তু তিনি থেমে থাকেননি।বড় চিকিৎসক হওয়ার নেশায় পরিশ্রম করেছেন,লড়াই চালিয়ে গেছেন।
চিকিৎসক ও ব্যক্তিজীবন বিষয়ক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘আমি আমার পরিবারকে সময় দিতে পারি না।বাচ্চাকে কখনো স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়নি।আমার সংসার আমার স্ত্রীকেই দেখাশোনা করতে হয়। চিকিৎসা পেশায় আসার পর আর কিছুই করা হয়নি। টানা রোগী দেখছি আর সার্জারি করছি।’ ‘এমনও হয়েছে যে অপারেশনে লম্বা সময় লেগেছে,আমি চাপ কমাতে বাইরে বের হয়ে চা খেয়েছি, সহকর্মীদের সঙ্গে হালকা গল্প করেছি এরপর আবার অপারেশন কক্ষে ঢুকে অপারেশন তদারকি করেছি। এ ছাড়া অপারেশন শেষে আমি প্রায়শই রিলাক্স মুডে চা অথবা কফিতে চুমুক দেই। প্রতিটি সফল অপারেশন আর রোগীর মুখের হাসি আমাকে সব কষ্ট ভুলিয়ে দেয়’।
ড. লুৎফর বলেন, ‘আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের যখন হার্ট অ্যাটাক হয় তখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেলে ডাক পড়েছিল আমার।তখনকার বিএমএ সভাপতি মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন বললেন, “তুই যেখানেই থাকিস দ্রুত বঙ্গবন্ধু হাসপাতালে আয়। কাদের ভাইয়ের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে, অবস্থা খুব খারাপ”। আমি গাড়িতে থেকেই ল্যাবএইডের আইসিইউতে ফোন করে আমার টিমকে রেডি হয়ে নিচে নামতে বলি। কাদের ভাই চোখ খুলছিলেন না।প্রধানমন্ত্রী এসে কাদের বলে ডাক দিতেই তার চোখের পাতা নড়ে উঠল। প্রধানমন্ত্রীকে আমি বলি, এখানে যন্ত্রপাতি না থাকায় সবকিছু ল্যাবএইড থেকে এনেছি।তিনি উপাচার্যকে ধমক দেন।পরদিন ভারত থেকে ডাক্তার দেবী শেঠি আসেন এবং কাদের সাহেবকে সিঙ্গাপুরে পাঠানো হয়।’
সে সময় ডা. দেবী শেঠি বলেছিলেন, ‘ঢাকার হৃদরোগ বিশেষজ্ঞরা যা করেছেন তা খুবই চমৎকার। ইউরোপ-আমেরিকাতেও এর চেয়ে বেশি কিছু করা সম্ভব নয়।’
হার্টের সফল চিকিৎসার নেপথ্যের নায়ক সার্জন লুৎফর রহমান প্রচারের বাইরে থাকায় তার কথা অনেকেরই অজানা।তার বড় চিকিৎসক হওয়ার রাস্তা সহজ ছিল না।তিনি ১৯৯৮ সালে হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল থেকে কার্ডিয়াক সার্জারির ওপর উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করেন এবং বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে একই হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন।হৃদরোগ হাসপাতালের চিকিৎসকদের দক্ষ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের দল আসত। তাদের কাছ থেকে দক্ষতা বাড়ানোর ও জটিল সার্জারির বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করেন তিনি।
সিকদার হাসপাতালে কার্ডিয়াক সার্জারি বিভাগে চিফ সার্জন করা হয় সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত সার্জন ডা.মুরালি ভেট্টাকে।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বিভাগ চালু করতে দেশি সার্জন থাকার বাধ্যবাধকতা থাকায় জয়নুল হক সিকদার খুঁজে বের করেন তাকে।সিকদার মেডিকেলের কর্তৃপক্ষ তাকে বলে,হৃদরোগ হাসপাতালের চাকরি ছেড়ে দিয়ে তাদের সঙ্গে যুক্ত হতে হবে।তার পরিবার আপত্তি জানায়।শেষ পর্যন্ত তিনি সিকদার হাসপাতালে যোগ দেন।
ডাক্তার লুৎফর বলেন, ‘আমার এ সিদ্ধান্ত অনেককেই হতবাক করেছিল।কিন্তু আমি বড় সার্জন হতে চেয়েছিলাম। সিঙ্গাপুরের বিশেষজ্ঞ দলের প্রশিক্ষণ আমাকে দক্ষ করে তুলেছে।’
তিনি বলেন, ‘সিকদার সাহেব বলতেন,মানুষের কান্না ভালো লাগে না, রোগীর মৃত্যু যেন না হয়।রোগী মারা গেলে তোমাকে রাখব না।যেহেতু সরকারি হাসপাতালে ফিরে যাওয়ার সুযোগ ছিল না,ফলে চাকরি চলে গেলে আমি কী করব এ চিন্তা ছিল।এ চাপে মাথাব্যথা নিয়ে কত যে প্যারাসিটামল খেয়ে ঘুমাতে হয়েছে তার ঠিক নেই।তবে ৫০০ অপারেশন করার পর আমি আর পেছনে তাকাইনি। একে একে জটিল সব অপারেশন করেছি।বিদেশের হাসপাতালও ঝুঁঁকি নেয়নি এমন রোগীরও অপারেশন করেছি অবলীলায়।’
ডা. লুৎফর বলেন, ‘২০০৭ সালে ১৮ বছরের একটি ছেলে আসে আমার কাছে। তার হার্টের অবস্থা খুব খারাপ।ভারতে তার অপারেশন হয়নি।তার আত্মীয়স্বজন ধরেই নিয়েছিলেন ছেলেটা মারা যাবে।তাই টাকা খরচ করে তার অপারেশন করাতে তারা রাজি ছিল না।ফুটফুটে একটা তরুণকে দেখে আমার মায়া হলো।বললাম,আমি অপারেশন করব,মরে গেলে টাকা দিতে হবে না।শেষ পর্যন্ত ছেলেটা সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে গেছে।আরেকটা রোগী পাই যার চার প্রজন্ম ধরে একজন করে পুরুষ সদস্য।এ রোগী না বাঁচলে বংশ রক্ষা হবে না।সব শুনে মনে হলো,হয় বংশ রক্ষা হবে না হয় নির্বংশ।অপারেশন করলাম,সফল হলাম; অপারেশন থিয়েটারের সামনে সবার কান্না,সে কী আনন্দ।’
তিনি বলেন, ‘একেকটা সার্জারি মানে একেকটা নতুন গল্প।রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরে বা তার স্বজনরা আমার চেম্বারে রান্না করা খাবার, উপহার নিয়ে আসেন।অনেক রোগী বিদেশে ঘুরতে গেলেও উপহার নিয়ে আসেন।এক মা তার ছেলেকে অপারেশন থিয়েটারে নেওয়ার আগে কেঁদেকেটে দোয়া-দরুদ পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন।তাকে বললাম,চুক্তিতে তো এটা লেখা ছিল না।এর জন্য অতিরিক্ত ফি দিতে হবে।শুনে তিনি হেসে ফেলেন এবং বলেন, স্যার! আমার পুকুরের মাছ নিয়ে আসব আমার ছেলেকে সুস্থ করে দিন।’
ডা. লুৎফর হার্ট চালু রেখে শতভাগ বিটিং হার্টে অপারেশন করার ক্ষেত্রে প্রায় শতভাগ সফল।তার সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য হচ্ছে,বুকের ভেতর থেকে রক্তনালি নিয়ে বাইপাস সার্জারি করা।এ পদ্ধতিকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় লিমা রিমা অর্থাৎ লেফট ইন্টারনাল মেমোরি আর্টেরি এবং রাইট ইন্টারনাল মেমোরি আর্টেরি। লিমা রিমা করে যদি বাইপাস করা হয়,তাহলে হার্টে কোনোদিন ব্লক হবে না। হার্ট সারাজীবন ভালো থাকবে।
২০০৪ সালের আগস্টে ল্যাবএইডে যোগ দেন এ চিকিৎসক। প্রায় ২০ বছর। তিনি বলেন, ‘তারা আমাকে স্বাধীনভাবে কাজ করার আশ্বাস দেয়।আমি আর কোথাও যুক্ত হইনি।এর মধ্যে নানা হাসপাতাল থেকে অফার এসেছে কিন্তু নানা কারণে যাওয়া হয়নি।’
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি