ষ্টাফ রিপোর্টার। হবিগঞ্জ শহরে দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে স্বাস্থ্যকর্মী সাইফুল ইসলামকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। আর এ হত্যাকাণ্ডে মাত্র ৩০ সেকেন্ড সময় নেয় খুনিরা। ‘কিলিং মিশনে’ অংশ নেয় তিনজন খুনি। যা ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণে বেড়িয়ে এসেছে।
এছাড়াও এরমধ্যেই সিসিটিভির ফুটেজ পর্যবেক্ষণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিমের তদন্তের মাধ্যমে শনাক্ত করা হয়েছে কিলিং মিশনে অংশ নেয়া যুবকদের। যদিও তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম পরিচয় প্রকাশ করছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তবে দ্রুত তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে বলে জানিয়েছেন তারা।
নিহত স্বাস্থ্যকর্মী সাইফুল ইসলাম হবিগঞ্জ জেলা সদর আধুনিক হাসপাতালের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট (ল্যাব) কর্মরত ছিলেন। তিনি মাধবপুর উপজেলার মনতলা গ্রামের নজরুল ইসলামের ছেলে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত মঙ্গলবার (২৮) ডিসেম্বর হাসপাতালে কর্মরত ছিলেন সাইফুল ইসলাম। দুপুরে হাসপাতাল থেকে এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে রিকশা যোগে নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড যাওয়ার জন্য রওনা হন তিনি। পথিমধ্যে শহরের টাউন হল রোড পার হয়ে স্যামসাং শো-রুম এলাকায় পৌঁছলে আগে থেকে ওৎ পেতে থাকা একদল যুবক তার গতিরোধ করে। এ সময় কোনো কিছু বুঝে উঠার আগেই সাইফুলকে রিকশা থেকে নামিয়ে বাঁশ দিয়ে মাথায় গুরুতর জখম করেন। এ সময় স্থানীয়রা এগিয়ে এলে দুর্বৃত্তরা পালিয়ে যায়। পরে তাকে উদ্ধার করে হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালে নিলে তাৎক্ষণিক উন্নত চিকিৎসার জন্য সিলেটে ওসমানী মেডিকেল কলেজে প্রেরণ করা হয়। সেখানে নিয়ে যাওয়া পরপরই সাইফুলকে মৃত ঘোষণা করেন চিকিৎসক। এর পূর্বে হাসপাতালে দায়িত্ব পালনকালে রক্ত পরীক্ষা করা নিয়ে তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডা হয় কয়েক যুবকের। এ ঘটনা নিয়ে হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হতে পারে বলে ধারণা নিহত সাইফুলের সহকর্মীদের।
এদিকে, এ হত্যাকাণ্ডের পরই অনুসন্ধানে মাঠে নামে পুলিশ, পিবিআই ও সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক টিম। খোঁজা শুরু হয় ঘটনাস্থলের আশপাশে থাকা সিসিটিভির ফুটেজ। একপর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে পৌঁছে সিসিটিভিতে ধরা পড়া সেই ভিডিও ফুটেজ। যেখানে দেখা যায়, রিকশা যোগে এক নারীকে সঙ্গে নিয়ে চৌধুরী বাজারের দিকে যাচ্ছিল সে। পথিমধ্যে তার রিকশা গতিরোধ করে টেনে সাইফুলকে রিকশা থেকে নামায় ঘাতকেরা। এ সময় তাদের সঙ্গে থাকা বাঁশ দিয়ে মাথায় আঘাত করে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মধ্যেই ‘কিলিং মিশন’ শেষ করে ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যায় তারা।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একটি বিশ্বস্ত সূত্র জানায়, এরমধ্যে খুনিদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তবে আরো দীর্ঘ তদন্তের স্বার্থে তাদের নাম প্রকাশ করা হচ্ছে না। দ্রুত খুনিদের আইনের আওতায় আনা হবে।
সাইফুলের সঙ্গে থাকা তার (ধর্ম মা) তাহমিনা বেগম চৌধুরীর বলেন, হাসপাতালে রক্ত দিতে আসা যুবকদের সঙ্গে কোনো এক বিষয় নিয়ে সাইফুলের কথা-কাটাকাটি হয়। একপর্যায়ে তার সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ে ওই যুবকরা।
তিনি বলেন, সাইফুল আমাকে গাড়িতে তুলে দিতে রিকশা যোগে নবীগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথিমধ্যে হঠাৎ করে রিকশা থেকে তাকে টেনে নামায় এক যুবক। পেছন থেকে আরও এক যুবক আসেন বড় একটি বাঁশ নিয়ে। সামান্য সময়ের মধ্যেই তাকে বাঁশ দিয়ে মেরে মাটিতে ফেলে তারা চলে যান। পরে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়।
নিহত সাইফুলের সহকর্মী ল্যাব টেকনিশিয়ান সজিবুল ইসলাম সজিব বলেন, সাইফুল করোনা টেস্টের কাজ শেষ করে রক্ত দাতাদের রক্ত নিচ্ছিলেন। এ সময় আমি অপর রুম থেকে শুনেছি তাদের কথা-কাটাকাটি হচ্ছে। পরে আমি ভেবেছি প্রতিদিনই এমন অনেক লোক এসে কাজে-অকাজে কথা-কাটাকাটি করেন। তেমন কিছু হবে না। এরপর রক্ত নেয়া শেষ হলে সে তার মাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসবে বলে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে যায়। পরে আমরা খবর পাই তাকে কেউ হত্যা করেছে।
সজিব বলেন, নির্মম এ হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারছি না। সহকর্মী হত্যার খুনিদের ফাঁসিও দাবি করেছেন তিনি।
সিলেট বিভাগীয় স্বাস্থ্য অধিদফতরের পরিচালক ডা. হিমাংশু লাল দাশ জানান, আমাদের একজন কর্মীর এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড আমরা মেনে নিতে পারছি না। এখানকার সব কর্মসূচির সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করেছি। আমরা প্রশাসনকে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছি। এরমধ্যে হত্যাকারীদের গ্রেফতার করা না হলে সিলেট বিভাগজুড়ে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হবে।
হবিগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বিএমএর সভাপতি ডা. মুশফিক হুসেন চৌধুরী জানান, চিকিৎসক, নার্স ও কর্মচারীদের আন্দোলনের সঙ্গে আমরা একাত্মতা পোষণ করছি। এ হত্যাকাণ্ডের বিচার না হলে আমাদের নিরাপত্তা কোথায় থাকে। আশা করি, পুলিশ প্রশাসন দ্রুত সময়ের মধ্যেই তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেবে।
হবিগঞ্জের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন) শৈলেন চাকমা জানান, পুলিশ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এরমধ্যে ঘটনাস্থল থেকে সিসিটিভির ফুটেজ সংগ্রহ করে ঘাতকদের শনাক্তের চেষ্টা করা হচ্ছে। আশাকরি দ্রুত সময়ের মধ্যেই হত্যাকারীরা ধরা পড়বে। এর পূর্বে ২৯ ডিসেম্বর হবিগঞ্জ সদর আধুনিক হাসপাতালের সামনে বিক্ষোভ সমাবেশ ও বিশাল মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করেন চিকিৎসক, নার্স ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা। এ সময় স্মারকলিপি দেওয়া হয় হবিগঞ্জের জেলা প্রশাসক ইশরাত জাহানের কাছে।
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি