নিজেস্ব প্রতিনিধি।।
২৬ শে মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষনা করেন।
ময়মনসিংহে-শহীদ-মুক্তিযোদ্ধাদের স্মরণে নির্মিত স্মৃতিস্তম্ভ চেতনায় অম্লান
ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন চেতনায় অম্লানে শহীদ তাজুল ইসলাম (২৭৮৪)
মহান মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাসে ময়মনসিংহ এক উজ্জ্বল অধ্যায়। ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
এর ২৪ ঘণ্টা পর। ২৭ মার্চ ১৯৭১ রাত ১২ টায় সংবাদ পায় ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন হাবিলদার মেজর আঃজব্বারের মাধ্যমে শহীদ তাজুল ইসলাম( তৎকালীন এসপির বর্ডিগার্ড)রাতে পুলিশ সদস্যরা ইপিআর সদস্যদের সাথে পরামর্শ করে এবং ভোরবেলায় পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার ভেঙ্গেফেলে শহীদ তাজুল ইসলাম।পুলিশ সদস্যদের এবং আনসার,ছাত্রদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়ে ইপিআর ক্যাম্প আক্রমন করে।
খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি ইপিআর সৈনিকদের সঙ্গে পাকিস্তানি ইপিআর’র সশস্ত্র যুদ্ধ হয়।
রাতভর চলা সেই যুদ্ধ পরদিন ২৮ মার্চ সকাল ৮টা পর্যন্ত চলে। যুদ্ধে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেন কমর আব্বারসহ ১২১ জন পাঞ্জাবি ইপিআর নিহত হয়। বিপরীতে শহীদ হন ৬ বাঙালি সেনা। শহীদ হন দেলোয়ার, একদাদুল, আনোয়ার, রাজ্জাক, হায়দার ও অজিত দত্ত।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের ৮ ঘণ্টার যুদ্ধ ‘খাগডহর যুদ্ধ’ নামে খ্যাত। এই যুদ্ধের তাৎপর্য বহুমাত্রিক।
স্বাধীনতা ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ময়মনসিংহে সংগঠিত হয় খাগডহর যুদ্ধ। যে যুদ্ধে নেতৃত্ব দেয় ও অংশ নেয় বাঙালি সেনারা ও পুলিশ সদস্যরা। সেই যুদ্ধে পাকিস্তানি ইপিআর অফিসার ও সৈনিক সবাই নিহত হয়। ২৮ মার্চ ময়মনসিংহে ছিলো অন্যরকম দিন। যেদিন যুদ্ধ জয়ের উল্লাসে বিজয় উদযাপন করে ময়মনসিংহ।
ইতিহাসবিদ ও মুক্তিযুদ্ধের গবেষকদের মতে, ২৭ মার্চে ময়মনসিংহের খাগডহর যুদ্ধে পাকিস্তানিরা পরাজিত হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিজয় সূচনা হয় ময়মনসিংহে।
ময়মনসিংহের ইতিহাস বলে, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণার পর কুমিল্লার কুমুরি যুদ্ধ জয় এবং ২৮ মার্চের পরও এই যুদ্ধ চলমান ছিলো। ইতিহাসে কুমুরি যুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম যুদ্ধ হিসেবে খ্যাত। স্বাধীনতা ঘোষণার পর প্রথম যুদ্ধ জয়ের গৌরবটি অর্জন হয় ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্প খাগডহরে সংগঠিত যুদ্ধে। ইতিহাসে এই যুদ্ধের যথাযথ মূল্যায়ন এখন সময়ের দাবি।
ময়মনসিংহে মুক্তিযুদ্ধের প্রথম বিজয় উদযাপন হয়ে আসছে গত কয়েক বছর ধরে। সেই সাথে এই যুদ্ধের সমরনায়কদের যথাযথ স্বীকৃতি প্রদানের দাবি রয়েছে। খাগডহর যুদ্ধে তৎকালীন বাঙালি পুলিশ শহীদ তাজুল ইসলাম ২৭৮৪ ময়মনসিংহ এবং
ইপিআর সৈনিক শেখ হারুন অর রশিদ, নান্নু মিয়া, আফতাব উদ্দিন, আনিসুর রহমান, জয়নাল আবেদীন, কাজী সাইদুর রহমান, মফিজ উদ্দিন, বাবু মান্নান, ফরহাদ, শহীদ দেলায়ারসহ অন্যান্য শহীদদের বীরত্বগাঁথা স্থানীয় জনমনে কিংবদন্তি হয়ে আছে।
২৭ মার্চ রাতে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি সৈনিকদের হত্যার নির্দেশনা এসেছিলো বেতার বার্তার সংকেতে। সেই সংকেত ধরতে পেয়েছিলেন বাঙালি সৈনিকরা। তারা সতর্ক হয়েছিলেন। তারা প্রস্তুতি নেন। রাত পৌনে ১২ টার দিকে পাঞ্জাবি সেনাদের অভিযান শুরুর সংকেতও দেওয়া হয়।
কিন্তু সম্ভাব্য পরিস্থিতির দিকে নজর রাখা বাঙালি সৈনিকরাই আগে আক্রমণ রচনা করে। দু’পক্ষে তুমুল গোলাগুলি হয়। পরদিন সকালে পাঞ্জাবী কমান্ডার ক্যাপ্টেন কমর আব্বাসহ ১৭ জন পাঞ্জাবী ইপিআর ক্যাম্প ছেড়ে পালানোর চেষ্টা করে।
ওই সময় তাদের এক কিলোমিটার এলাকা দৌড়িয়ে নিয়ে পরাজিত করে বাঙালি সিপাহীরা। এই যুদ্ধে অসীম সাহসী অগ্রণী ভূমিকা রাখা শহীদ তাজুল(পুলিশ) ইসলামের ডান হাতে গুলি লেগেছিল, শেখ হারুন গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। যুদ্ধ শেষে খাগডহর ইপিআর ক্যাম্পের দায়িত্ব বুঝে নেন সুবেদার ফরিদ উদ্দিন। পরে তৎকালীন মেজর শফিউল্লাহ, ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান প্রমুখ ময়মনসিংহে আসেন।
মেজর শফিউল্লাহ ময়মনসিংহ ইপিআর ক্যাম্পের দায়িত্ব নেন। এই সময় হাজারো ছাত্রজনতা খাগডহর ইপিআর ক্যাম্প ঘেরাও করে। ২৮ মার্চ খাগডহর যুদ্ধ জয় ময়মনসিংহের মানুষজনকে উজ্জীবিত করে। দিনটি ছিলো ঘটনাবহুল। পুলিশ লাইন থেকে অস্ত্রাগার ভেঙ্গে অস্ত্র সরবরাহ করেন পুলিশ সদস্য শহীদ তাজুল ইসলাম (২৭৮৪)।সেদিন ময়মনসিংহ পুলিশের ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে গর্বের এক অধ্যায়।
মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ ছাত্রদের মাঝে অস্ত্র বিতরণ করেন। যুদ্ধে অংশ নেওয়া ইপিআর (বাঙালি) জওয়ানদের শহরের মাঝে একটি স্কুলে (বর্তমানে গার্লস ক্যাডেট কলেজ) নেওয়া হয়। পরদিন ট্রেনযোগে তারা ঢাকা-জয়দেবপুরের উদ্দেশে রওনা হন।
২৮ মার্চ শহরের ছাত্র-জনতা মুক্তিকামী মানুষ ছিলো উৎফুল্ল ও উন্মুক্ত। পাঞ্জাবি ইপিআরদের খতম করার পরিণামে পাকিস্তানিরা ময়মনসিংহে বম্বিং করতে পারে- সেই আতঙ্ক জনমনে ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু ২৩ এপ্রিল পর্যন্ত ময়মনসিংহ ছিলো হানাদারমুক্ত।
ইতিহাসবিদরা এই সময়টাকে ‘ময়মনসিংহ অন্তবর্তীকালীন স্বাধীন’ বলে উল্লেখ করেছেন। মুক্ত ময়মনসিংহ জুড়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার সেই অনুভূতি মানুষকে সদা জাগ্রত করে রাখে।
এরপর ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের সংগঠকরা মুক্তিযুদ্ধে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাওয়া শুরু করেন। ৭ মার্চের পর ময়মনসিংহে যুদ্ধের যে রণপ্রস্তুতি শুরু হয়েছিলো তা ২৬ মার্চ পর্যন্ত ছিলো প্রস্তুতিমূলক। ২৭ মার্চ রাতে যুদ্ধের পরদিন ২৮ মার্চ সেই যুদ্ধ প্রস্তুতি আরো তীব্রতর হয়।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার খবর ২৭ মার্চ ময়মনসিংহে ছড়িয়ে পড়ে। দুপুর থেকেই শহর ও আশপাশ গ্রামগুলোর লোকজন দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে শহরে বিক্ষোভ মিছিলে প্রকম্পিত করে তোলে। ছাত্র-জনতা-কৃষক-শ্রমিক স্বাধীনতার ঘোষণাকে স্বাগত জানায়।
খাগডহর ক্যাম্প ঘেরাও করা ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে অন্যান্য অনেকের মাঝে ছাত্রনেতা ম. হামিদের ভূমিকা ছিলো উল্লেখযোগ্য। বাঙালি ইপিআর সিপাহীরা ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ২৫ মার্চ ঢাকায় পিলখানায় বাঙালি ইপিআর হত্যার পর ২৭ মার্চ রাতে ময়মনসিংহ পুলিশ লাইন এবং ইপিআর ক্যাম্পে বাঙালি নিধনের পরিকল্পনা ছিলো।
বলা হয়েছিলো বাঙালি পুলিশ এবং ইপিআরদের অস্ত্র জমা
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি